কক্সবাংলা ডটকম(১২ সেপ্টেম্বর) :: দেশের সংস্কারের জন্য ছয় বিশিষ্টজনের নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ ছয়টি কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সংশ্লিষ্ট কমিশনের অন্য সদস্য নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। কমিশন দ্রুতই সংস্কারের কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করে কাজ শুরু করবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন নবগঠিত কমিশনের প্রধানরা।
যত দ্রুত সম্ভব সংস্কার প্রক্রিয়া শেষ করে নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণা এবং একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন রাজনীতিবিদরা।
তারা বলছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঘোষিত কমিশনগুলো তাদের চূড়ান্ত সুপারিশ প্রণয়ন প্রক্রিয়া নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করবে বলেই তাদের আশা।
এরপর জনগণের আকাঙ্ক্ষামূলক একটি প্রকৃত নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা দেওয়া হবে, এমনটাও প্রত্যাশা তাদের।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত বুধবার জাতির উদ্দেশে ভাষণে রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা তৈরির জন্য একটি পথরেখা ঘোষণা করেছেন। যেখানে ছয়টি কমিশন গঠনের কথা জানিয়ে এর মাধ্যমে সংস্কারের রূপরেখা চূড়ান্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
প্রধান উপদেষ্টার এমন ঘোষণার প্রেক্ষাপটে দলীয় সংবাদ সম্মেলনে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
এ ছাড়া কথা বলেছে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের সঙ্গে।
এই তিন নেতা আরও বলেছেন, জনগণের আকাঙ্ক্ষার জরুরি ক্ষেত্রগুলোতে সংস্কারের কাজ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে রাখা উচিত। আর রাষ্ট্রের মৌলিক বিষয়গুলোতে সংস্কারের বিষয়গুলো নির্বাচিত সরকারের হাতে তুলে দেওয়াটা যৌক্তিক হবে।
সংস্কার কাজগুলো যেন অতিদ্রুত শেষ হয়: মির্জা ফখরুল
বৃহস্পতিবার নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে যেসব সংস্কারের কথা বলেছেন এবং যাদের দায়িত্ব দিয়েছেন, এই সংস্কারগুলো যেন অতিদ্রুত হয়। অন্তর্বর্তী সরকার যত দ্রুত সম্ভব তাদের কাজগুলো শেষ করে নির্বাচনের দিকে যাবে– এমনটাই তাদের প্রত্যাশা।
তিনি বলেন, বিগত ফ্যাসিবাদী সরকার গণতান্ত্রিক অধিকার একেবারে ধ্বংস করে ফেলেছিল। আমরা সবাই সংস্কারের কথা বলছি এবং সংস্কার যে প্রয়োজন, সেটা বলেছি। সে ক্ষেত্রে অতিদ্রুত যেন এই সংস্কারগুলো করা হয়। মূল যে বিষয়টা, গণতন্ত্রের জন্য জনগণের প্রতিনিধিদের যে শাসন, জনগণের নির্বাচিত সংসদ দিয়ে দেশ পরিচালনা, সে বিষয় যেন দ্রুততার সঙ্গে হয়, সেটি আমাদের প্রত্যাশা থাকবে।
মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাফল্য কামনা করি। অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের কাজ করছে। তাদের সময় ও সুযোগ দেওয়ার জন্য আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আশা করি, তারা যথা শিগগির তাদের কাজগুলো শেষ করে নির্বাচনের দিকে যাবে। আমরা আশা করি, তারা শিগগিরই সম্ভব স্বল্প সময়ের মধ্যে সংস্কারের কাজগুলো শেষ করে নির্বাচনের দিকে যাবেন।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, এই সরকার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এসেছে। আমরা আশা করব, তারা জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাবে। একটি কথা স্পষ্টভাবে বলা প্রয়োজন, গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। গণতন্ত্র হচ্ছে একমাত্র ব্যবস্থা, যা জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারে। সে জন্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠাগুলোকে তৈরি করাই হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কিন্তু সেই কাজটাতে জনগণের সম্পৃক্ততা থাকতে হবে, জনগণ কী চায়, জনগণ কীভাবে জিনিসটা দেখতে চায়– সে বিষয়টা থাকতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা আশা করব, বর্তমান যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আছে তারা সেটা উপলব্ধি করবে; যাদের সংস্কারের দায়িত্ব দেওয়া আছে, তারা অত্যন্ত সুচারুরূপে তা পালন করার চেষ্টা করবে। সংস্কারের মাধ্যমে জনগণ যাতে উপকৃত হয়– সে প্রত্যাশাই আমাদের থাকবে। নির্বাচনের মহাসড়কে উঠতে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত সংস্কারকাজগুলো দ্রুত শেষ হবে– এমনটাই প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন বিএনপি মহাসচিব।
সংস্কার শেষে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করুন : জি এম কাদের
প্রতিক্রিয়ায় জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত এক মাসে কী করেছে, তার বিস্তারিত জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তুলে ধরেছেন প্রধান উপদেষ্টা। সেখানে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য তিনি দেশের বিশিষ্ট ছয়জনকে দায়িত্ব দিয়েছেন। বিচক্ষণতার সঙ্গে তিনি এই ছয়জনকে বাছাই করেছেন। এদের সবাই যোগ্য ব্যক্তি। যাকে যেখানে দেওয়া হয়েছে, সেখানে তাদের মতো যোগ্য আর কেউ আছেন বলে মনে করি না।
তিনি বলেন, আমরা ভালো নির্বাচন দেখেছি। তবে ভালো সরকার দেখতে পাইনি। দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন নিয়ে সংসদে গেছে কোনো কোনো দল। তবে তাদের শাসনব্যবস্থা গণতান্ত্রিক ছিল না, স্বৈরতান্ত্রিক ছিল। এজন্য শুধু সুষ্ঠু নির্বাচন নয়, জবাবদিহিতামূলক সরকার হতে হবে। আর নির্বাচন ব্যবস্থাকেও যাতে আগামীতে কেউ কুক্ষিগত করতে না পারে, সেজন্য এই ছয়জন বিশিষ্ট ব্যক্তি উদ্যোগ নেবেন এবং সংস্কার করবেন বলে তিনি মনে করছেন।
জি এম কাদের বলেন, এই ছয়জন অক্টোবর থেকে কাজ শুরু করে পরবর্তী তিন মাস সংস্কারের বিভিন্ন ধাপ সম্পন্ন করবেন। প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট এবং এগুলো তাদেরও (জাপা) দাবি। ওই সময়ের পর যদি ছয়জন মনে করেন তাদের আরও সময়ের দরকার, তাহলে সেই সময়ও দেওয়া দরকার। তাতে তাদের আপত্তি নেই।
তিনি বলেন, আমরা ‘বাই দ্য পিপল সরকার’ দেখেছি, কিন্তু ‘ফর দ্য পিপল সরকার’ দেখিনি; ‘অব দ্য পিপল সরকার’ও দেখছি না। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যখন দায়িত্ব নিয়েছে এবং তারা এখন পর্যন্ত যা করছে, তাতে আমরা সন্তুষ্ট। এখন পরবর্তী কাজ দেখে তাদের মূল্যায়ন করতে পারব। এসব কাজ শেষেই তারা নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করবে বলে বিশ্বাস করি। এজন্য তারা সব দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করবে বলে মনে করছি।
সমাজতন্ত্র অভিমুখিন সংস্কারের সুপারিশ প্রণয়ন করা প্রয়োজন : মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের জন্য সুপারিশ তৈরি করতে ছয়টি কমিশন গঠন করেছে। কিন্তু একটা মৌলিক প্রশ্নের মীমাংসা না করে এই সংস্কার কার্যক্রম অগ্রসর করা অসম্ভব বলে মনে করি। সেই মৌলিক প্রশ্ন হচ্ছে– সংস্কারটা কোন অভিমুখে হবে। বর্তমানে দুনিয়ায় দুইটা সমাজব্যবস্থা পাশাপাশি বিরাজ করছে।
একদিকে পুঁজিবাদ, আরেকদিকে সমাজতন্ত্র। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম সমাজতন্ত্র অভিমুখে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য। সুতরাং সমাজতন্ত্র অভিমুখিন সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনার ভিত্তিতেই প্রতিটি কমিশনের সংস্কারের জন্য সুপারিশ প্রণয়ন করা প্রয়োজন বলে মনে করি।
তিনি বলেন, আরও সুস্পষ্টভাবে বলতে গেলে আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির ভেতর দিয়ে যে চিন্তাধারার অভিব্যক্তি ঘটেছে, সংস্কারের ক্ষেত্রে সেটার বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করা উচিত হবে না। সেটা করলে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যও হবে না।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, সতর্ক থাকতে হবে– এই সরকার যেহেতু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, তাই তাদের এমন কোনো দায়িত্ব নেওয়া উচিত নয়, যেটা তার ম্যান্ডেটের বাইরে চলে যায়। সে রকম কোনো মৌলিক ইস্যু এলে সেটা মীমাংসার দায়িত্ব যত দ্রুত সম্ভব জনগণের সম্মতিতে জনগণের আস্থাভাজন একটি নির্বাচিত সরকার গঠন করে তাদের হাতে দেওয়া উচিত।
তবে মৌলিক ইস্যুগুলো বাদে যেগুলো জরুরিভিত্তিতে সংস্কার করা প্রয়োজন, সেগুলো অবশ্যই অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে নেওয়া উচিত। আর সংস্কার প্রক্রিয়া শেষ করে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের মাধ্যমে একটা নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া উচিত।
সংস্কার বিষয়ে নিজের প্রত্যাশা তুলে ধরে সিপিবির এই নেতা বলেন, সংবিধান সংশোধন, নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার কিংবা দুর্নীতি প্রতিরোধসহ সংস্কারের প্রতিটি বিষয়েই কমিউনিস্ট পার্টি ও বামপন্থিরা বহুদিন ধরেই সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা ও দাবিগুলো তুলে ধরে আসছে। সুতরাং আশা করব, আমাদের সেই প্রস্তাবনা ও দাবিগুলো গুরুত্ব দিয়ে কমিশনের সুপারিশমালায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। আরও আশা করব, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে খোলামেলা আলোচনার ভিত্তিতে একটা চূড়ান্ত রিপোর্ট তৈরি হবে। আর আমাদের প্রস্তাবনা ও সুপারিশ নিয়ে যে কোনো সময়, যখনই ডাকা হবে– আমরা আলোচনা করতে প্রস্তুত আছি।
Posted ২:২৭ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta